০.১ শুন্যের ধারণা অনন্য


অনেক বছর আগে, একদিন এক বালক এক ব্যক্তির সাথে সমুদ্র-সৈকতে সূর্যাস্ত দেখতে গিয়েছিল। সমুদ্র জিনিসটা অসম্ভব সুন্দর, আর এটা যদি হয় সন্ধ্যা বেলা তবে আর কোন কথা থাকে না। ঢেউ এসে কিনারে আছড়ে পড়বে, পায়ে পানির মৃদু স্পর্শ লাগবে আর গোধুলির আবছা আধো-অন্ধকার। এই যেন প্রকৃতির সঙ্গে মনের মেল বন্ধন।

সূর্যাস্ত দেখে যখন তারা তীরে হেঁটে হেঁটে  ফিরছিল। এমন সময় হঠাৎ করে ছেলেটা পায়ের নিচে শক্ত কিছুর অনুভব করলো। কৌতুহলী হয়ে দেখার জন্য সে নিজের নিচের দিকে ঝুঁকে দিয়েছিল। তারপর যেটা সে পেল, সেটা পাওয়ায় স্বাভাবিক ছিল। এটা ছিল খালি একটা ঝিনুকের খোলক!

স্বভাবতই এটা দেখে তার একটু রাগ হয়েছিল। কিন্তু কিছু একটা ভেবে খালি খোলকটা, ফেলে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারপরে আবার তারা হাঁটতে শুরু করেছিল। হাঁটতে হাঁটতে কোন এক সময় অকারনেই ছেলেটার হাত (যে হাতে ঝিনুকের খোলক ছিল) তার কানের কাছে নিয়েছিল। তখন কি হয়েছিল জানেন?

অদ্ভুত একটা শব্দ শুনেছিল সে। প্রথমে বিশ্বাস হয় নি এই মৃদু, মেলোডিয়াস, ছন্দময় শব্দটা তার হাতের শুন্য খোলক থেকেই আসছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন একই রকম শব্দ শুনতে পেল, ছেলেটি তখন হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিল, ভয় আর উৎকন্ঠায় সে তার পাশের ব্যক্তিটির হাত শক্তভাবে আঁকড়ে ধরেছিল।

সব কিছু শুনে ব্যক্তিটি বলেছিল, ভয় পেও না নিয়ান। এ মৃদু-মেলোডিয়াস শব্দটি আর কিছুই নয়, শূন্য সংখ্যাটির প্রতিধ্বনি ছাড়া, যেটা হাজার বছর আগে মানুষ কোন না কোন সময় শুনছে। আমাদের দৈনন্দিন কাজে ত্রুটিহীন হিসাবনিকাশে এটি ছায়ার মত সাহায্য করছে।

এই 'শুন্য', সংখ্যাপদ্ধতির একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা, যদিও এটিকে আগে সংখ্যা ভাবা হতো না। ভাবা হত এটি অন্য যে কোন সংখ্যার থেকে কম মানের বা এর কাছাকাছি কিছু একটা হবে! মানব সভ্যতার ইতিহাসে ১৫,০০০ বছরের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জিরো নিজেকে একটি পূর্ণাঙ্গ সংখ্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।

গনিতে জিরো বা শূন্যের সৌন্দর্য্য আসলে এর দু'টি ব্যবহার থেকে বোঝা যায়। একটি হলো এটি যেকোন দশমিক সংখ্যার প্লেসহোল্ডার (স্থানীয় মান) হিসেবে কাজ করে। যেমন, তিন একটি সংখ্যা, তবে যখন এর ডানে শূন্য বসানো হয় তখন তার মান ১০ গুন বেড়ে যায়। আর ৩৩০ সংখ্যাটি যে ৩৩ সংখ্যাটির চেয়ে বড় সেটা কিন্তু সবার জানা। ঠিক এই কাজটি শূন্য অসাধারণভাবে করতে পারে। বিশ্বাস হচ্ছে না?

আচ্ছা! যখন শুন্য ছিল না তখন মানুষ কিভাবে কোন সংখ্যা পূর্ণাঙ্গভাবে লিখত? ধরুন, আপনি একটি বই কিনছেন যার দাম ১২০ টাকা। বাসায় ফিরে আপনার খরচের খাতায় সেটা কিভাবে লিখবেন? হ্যাঁ, যখন শুন্য ছিল না তখনও কিন্তু মানুষ হিসেব ঠিকই করত। কিভাবে?

ব্যবিলনীয়রা যখন শুন্যের ব্যবহার জানতো না, তখন জিরো বা শূন্য বোঝাতে সংখ্যাগুলোর মধ্যে স্পেস বা ফাঁকা জায়গা রাখত। তারপর গ্রীক, ম্যায়ান সভ্যতা ঘুরে ভারতবর্ষে এসে গনিতবিদ ব্রোমগুপ্তের হাতে সপ্তম সেঞ্চুরিতে জিরো একটি নতুন আইডেন্টি খুঁজে পায়। তিনি ১-৯ পর্যন্ত সংখ্যার সাথে ছোট ডট (.) চিহ্ন ব্যবহার করে শুন্যের সমস্যা কিছুটা দূর করেন। তবে সমসাময়িক বাঘা বাঘা স্কলারদের দ্বিধা-দন্দের কারনে তিনি নিজেই কনফিউজড হয়ে যান এই চিহ্ন ব্যবহার করে শুন্য বা জিরো বোঝানো ঠিক হবে কিনা!

তারপর ভারতবর্ষ থেকে চায়না, আরবদেশে হয়ে বিভিন্ন দেশে ব্রোমগুপ্তের কনসেপ্ট নিয়ে জোরেশোরে কাজ শুরু হয়। তবে সব ঠিক থাকলেও ইউরোপ থেকে শুন্যের ধারনা তীব্র বাঁধার মুখে পড়ে। রোমান সম্রাট কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না হিন্দু-আরবিক সিস্টেমে ব্যবহার করে তারা হিসেবে করবে। বরং, তারা নিজের সংখ্যা পদ্ধতি নিয়ে কাজ চালানোর উপর জোর দিতে বলেন।

তবে যাইহোক ত্রয়োদশ সেঞ্চুরিতে এসে ইতালিয়ান ম্যাথমেটিশিয়ান ফিবোনাক্কি আশার আলো জ্বেলে 'শুন্য' বা 'জিরো' নিয়ে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়েছিলেন। তিনি তার পরীক্ষার দ্বারা প্রমান করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, শুন্যে নিজেই একটি ইউনিক সংখ্যা এবং এর প্রকৃত অর্থ।

আর হ্যাঁ, দ্বিতীয় ব্যবহারটি হলোঃ 'জিরো' পজিটিভ ও নেগিটিভ সংখ্যার মিডেলম্যান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি সাথে অন্য যেকোন সংখ্যার যোগ, বিয়োগ, গুন এবং ভাগ করা যায়। যদিও সাধারনভাবে শুন্য দিয়ে কোন সংখ্যাকে ভাগ করা যায় না। আবার অনেক বলেন এ ক্ষেত্রে ফলাফলটি ইনফিনিটি হয়। তবে মনে রাখতে হবে ইনফিনিটি কোন সংখ্যা নয়, এটি আলাদা একটা কনসেপ্ট।

তারপর নিউটনের ক্যালকুলাস আবিষ্কার জিরোর গুরুত্বকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়। গনিত থেকে যার শুরু, পরে বিস্তৃত হয়েছে ম্যাকানিক্যাল সহ কম্পিউটার বিজ্ঞান, ন্যানো প্রযুক্তির মত সব শাখাতে। তবে শুন্য বা জিরোর সৌন্দর্য এখন একটু বলতে বাকি!

কেমিস্ট্রির অ্যাটোমিক থিওরিতেও 'শুন্য' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, চারটি টেট্রা নিউট্রনের ক্লাসটার একটি সিঙ্গেল অ্যাটম বা পরমানুর মতই স্টেবল হতে পারে। সুতরাং, শুন্য প্রোটন এবং শুন্য ইলেকট্রন সংখ্যা নিয়েও এখন একটি পরমানুর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায়। (যদি বিষয়টি এখনও গবেষণাধীন)


অন্যদিকে, পদার্থ বিজ্ঞানে অ্যাবসলুট জিরো টেমপ্রেচার বা,পরম শুন্য তাপমাত্রা তাপগতি বিদ্যায় পানির বরফ বিন্দু নির্দেশ করে। এছাড়াও জিরো লেভেল অ্যানার্জি বা শক্তি কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্যালের ফিজিক্সের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। 

এসব কারনে বলা যায়, যদিও আমরা জিরোকে পেয়েছি শুন্য স্থান এবং ডটের (.) ধারনা থেকে, তবে জিরো তার চেয়েও বড় কোন আইডিয়া! জিরো একটি লাইমলাইট যেটা নিজেই নিজের আলো ছড়িয়েছে আর আমাদেরকে দিয়েছে শুন্যতা থেকে কিছু পাওয়ার অনন্য ধারণা। 

Comments

Popular posts from this blog

What Makes Me Happy!!!

Augusta Ada: The first programmer

1.1 Writing: As A Communication Tool