মায়া ডি ফ্রাংক
পর্ব-০১
শুরুটা ১৯৪২ সালের শেষ দিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভৎসতা ৪র্থ বছরেও কমেনি। বরং বিষাক্ত কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী আরও বড় হচ্ছে। একদিকে অক্ষশক্তির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে হিটলার আর অন্যদিকে মিত্রশক্তির জোট ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভাবা হচ্ছিল হিটলারের সুদক্ষ যুদ্ধ পরিচালনার কাছে হার মানতে বাধ্য হবে বিশ্ব শক্তি। জাপান এই কূটকৌশলে জার্মানির প্রধান অস্ত্র। অন্যদিকে ইংরেজ সেনাপতির নজর আমেরিকাকে পাশে পাওয়া। দুই শক্তিশালী দলের মাঝে অবস্থান করছে চীন, রাশিয়ার মাস্টার মাইন্ড ব্রেন। এক কথায় কেউ কারোও সাথে কম যায় না।
তবে, যুদ্ধ বর্ণনা করা আমার শোভা পায় না। আমি কোন ইতিহাসবিদ নয়, এবিষয়ে কথা বললে ভুলের মাসুল দিতে দিতেই আমার দম বের হয়ে যাবে। আর তাতে গল্পের সলিলসমাধি ঘটানো মুশকিল হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ইহুদীবিদ্বেষী নীতি প্রয়োগ করার জন্য কাজ করছে বিশেষ নাৎসি বাহিনী। তারা গ্রাম, পাড়া মহল্লা, শহরের গলি থেকে ইহুদী মানুষদের খুঁজে এনে বিশেষ টর্চার সেলে আটকে রাখত।
আর এই সেলেই ভাগ্যর নির্মাণ পরিনতিতে আটকে পরেছিল মায়া ডি ফ্রাংক। ষোল বছর বয়সী মেয়েটি দেখত ঠিক কিছুটা খর্বকার, কৃষ্ণ বর্নের চেহারা, আর মুখে চাপা হাসি। কিছুটা লাজুক।
জার্মানে তার মত মেয়ে দেখা যায় না। জার্মানে যাদের জন্ম তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো সুন্দর ফিগার, লম্বা হাত-পা, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাদের হাস্যোউজ্জ্বল চাহনি। সেটার জন্য যেকোন পুরুষ আকর্ষিত হতে বাধ্য।
সেই তুলনায় মায়া কিছুই না। কোন পুরুষ যে তাকে কামনা করতে পারে, ভালবাসতে পারে সে তা জানতো না। ষোল বছর বয়সী এই মেয়েটির তীব্র আবেগ থাকলেও নিজেকে বেঁধে রাখতে হয়েছিল শিকলে। একদিকে সে ও তার পরিবার এসেছে উত্তর আমেরিকার এক নামহীন রাজ্য থেকে। অন্যদিকে তারা ইহুদি ধর্মের অনুসারী। সব মিলেয়ে নতুন পরিবেশ গত দশ বছর তার কেটেছে ঘরের জানালা দিয়ে পৃথিবী দেখে।
মাঝে মাঝে বাবার হাত ধরে রাতে কিছুটা পথ হেঁটেছে। তখন তার চাপা হাসিটা সূর্যমুখীর মত ছড়িয়ে পড়ত। তবে হাসির বিস্তার ছিল বাবা মেয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কারন, ১৯৩৯ সালের পর থেকে জার্মানে ইহুদীদের যে হাসতে মানা! তারা এখন মানুষ তো নয়ই বরং পশুর চেয়ে নিকৃষ্টতর কোন প্রাণি। যাদের বেঁচে থাকাটায় সবচেয়ে বড় রহস্য!
মায়ার বয়সী ছেলেমেয়েরা যখন স্কুলে, খেলাধুলায় আর বন্ধুদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত সময় পার করছে। সেখানে, মায়ার দিন কাটতো কয়েকটা গল্পের বইয়ে ডুবে থেকে। গল্পের রাজকন্যা হওয়ার ইচ্ছা সারাক্ষণ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত কল্পনার রাজ্যে। সে বিশ্বাস করতো একদিন পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে তার জন্য রাজকুমার আসবে। যদিও কিছুক্ষণ যাওয়ার পর তার স্বপ্ন দিবাস্বপ্নের মত মিলিয়ে যেত। তখন একরাশ দুঃখের কালো মেঘ তার মনটা ঢেকে ফেলতো।
১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। প্রতিদিনের মত মেয়ে অপেক্ষা করছে তার বাবা কখন বাড়ি ফিরবে। তার বাবা একটা কাঠের দোকানে আসবাবপত্র তৈরির কাজ করত। অন্যের মেয়ের ঘর সাজানোর জিনিস তৈরি করতে করতে ভাবতো তার আদরের মেয়ে মায়া বড় হচ্ছে। খুব ইচ্ছা ছিল নিজের মেয়ের ঘর সে এমন সব সুন্দর ডিজাইন দিয়ে সাজিয়ে দেবে যেটা আগে কখনও সে বানায় নি। কারন, অন্যদের জন্য যে কাজ করেছে সেটা দুমুঠো খাওয়ার জন্য। কিন্তু নিজের মেয়ের ঘর সে সাজাবে ভালবাসা দিয়ে। প্রতিটি আসবাবে থাকবে
সন্ধ্যা গড়িয়ে যখন রাত নেমে এল, তখন ও বাবা বাড়ি ফেরিনি বলে মেয়ের দু'চিন্তা কমছে না। একবার ভাবে তার বাবা হয়তো কাজ শেষ করে ফিরবে, আবার ভাবছে তারা বাবাকে হিটলারের কুকুর গুলো ধরে নিয়ে যায়নি তো! সে আর ভাবতে পারছে না। তার মা তাকে বুঝিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। যদিও কেউ কিছু খায় নি আজ।
রাত যত গভীর হচ্ছে মায়ের মনে ভয় গুলো তার তত দাগ কেটে যাচ্ছে। একের পর এক কুচিন্তা তার মনকে ভার করে তুলছে। এটা স্বাভাবিক যে, ভাল চিন্তা ভাল কিছুর আকর্ষণ করে আর খারাপ চিন্তা খারাপ কিছুকে আকর্ষণ করে। তবে সত্যি হল কি, খারাপ চিন্তার আকর্ষণ করার ক্ষমতা অত্যন্ত প্রবল এবং চারপাশে এমনভাবে বিস্তার করে থাকে, যে আমরা এই লুপ থেকে বের হতে পারিনা।
ভোরবেলা মেয়ে যখন ঘুম থেকে জেগে উঠল তখনও অন্ধকার কাটে নি। উঠেই চোখ মুছতে মুছতে, বাবা বাবা বলতে বলতে ছুটে গেল বারান্দায়। বারান্দার একপাশে ছোট একটা খুপরি ঘরের মত জায়গায় তার বাবা ঘুমায়। গিয়ে দেখে বাবার বিছানা শুন্য। তার পাশেই একটা চৌকিতে মা বসে আছে আর থেকে থেকে মৃদু স্বরে বিলাপ করছে।
মাকে জিজ্ঞেস করল, বাবা ফেরেনি এখনও? মা কিছু বলতে পারছে না। মেয়ের সামনে নিজেকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করছে। তবুও তার দুচোখ বেয়ে জল ছড়িয়ে পড়ছে। আর মনে মনে প্রার্থনা করছে, যেন তার স্বামী ভাল ভাবে ফিরে আসে। পরক্ষনেই মনে দুঃচিন্তা হচ্ছে যদি সে আর কখনও ফিরে না আসে! মেয়ে নিয়ে সে কোথায় যাবে?কার কাছে খোঁজ করবে?
মায়া তার মায়ের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। আর মনে মনে ভাবছে সকালেও যদি বাবা না ফিরে আসে তবে সে একা খুঁজতে বেড় হবে। মাকে নিয়ে যাবে না, কারন মা থাকলে সে বেশি দূর খুঁজতে যেতে পারবে না।
বরং, খুঁজে পেতে দেরি হলে মাকে শান্ত করা মুসকিল হয়ে যাবে। সে আপন মনে এসব ভাবছে আর বাড়ির প্রবেশ পথের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করছে।
বাইরের আকাশ পরিষ্কার হলেও সূর্য উঠতে এখনও ঘন্টা দুই বাকি। মায়া আর বারান্দায় থাকতে না পেরে প্রবেশ পথের মাথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু কোথায় তার বাবা? কখন আসব? রাস্তা তো ফাঁকা, কোথায় একটা কাক পঙ্খিকেও দেখা যাচ্ছে না।
সূর্য উঠতে শুরু করার সাথে সাথেই সে পোশাক চেন্জ করে মাকে বলল, আমি বাবাকে খুঁজতে যাচ্ছি। মা নিষেধ করল, কিন্তু সে শুনলো না। নিয়তি যে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কার সাধ্য তাকে আটকে রাখার।
কয়েকশত ক্রোশ হেঁটে প্রথমে গেল বাবার কাজের জায়গায়। গিয়ে দেখে সেখানে মহা শশান। কেউ নেই, কোন শব্দ ও নেই আশে পাশে। তারপর সে ছুঁটলো হাসপাতালে। খোঁজখবর নিলো কিন্তু বাবাকে পেলো না কোন কক্ষেই। তারপর আরও কয়েক স্থানে খুজ নিয়েছে। কিন্তু থানা যেতে পারে নি। কারন, থানায় যদি শোনে সে ও তার বাবা ইহুদি, তাহলে আর রক্ষা নেই।
বাবাকে না পেয়ে মন মরা হয়ে বাড়ি ফেরে এলো। মা মুখ দেখেই বুঝছে বাবাকে খুজে পায়নি। মা মেয়ের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে, কিন্তু খাবার যে মুখে উঠছে না বাবার চিন্তা।
দ্বিতীয় দিনের মত মায়া সব কিছু ভয় উপেক্ষা করে, আবারও রাস্তায় বের হয়েছে। পথ এখনও নিরব৷ লোকের মুখে সে শুনেছে গত রাতে নাৎসী বাহিনী প্রায় ত্রিশ জনকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে কয়েক জনকে ছেড়ে দিয়েছে। আর বাকিদের সাথে কি ঘটেছে তা কেউ জানে না।
সে আজ নদীর ধার বেয়ে এগিয়ে চলেছে। খুঁজতে খুঁজতে সে অনেকটা পথ চলে এসেছি। সামনে কিছুটা ঝোপঝাড়ের মত কি অংশ দেখতে পেয়ে, সে ভাবল আর সামনে গিয়ে কি হবে। এদিক কেন তার বাবা থাকবে।
তারপর কিছুক্ষন সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবল ফিরে আসবে। তারপরও সে ফিরতে ফিরতে পারছে না। মাঝে অনেক সময় পার হয়ে গেল.....
পরবর্তী পর্ব-০২ পড়তে সাথে থাকুন.....
Comments
Post a Comment